সংস্কৃতে রচিত রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, অন্যান্য পুরাণ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ মধ্যযুগের বাংলা কাব্যকে ক্লাসিক মহিমা এনে দিয়েছে। গুপ্তযুগ থেকেই বাংলাদেশের সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার, পৌরাণিক সংস্কার সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে দৃঢ়মূল হয়েছে। বৌদ্ধ পালরাজাদের মধ্যে আর্যশাস্ত্র-সংহিতা, পুরাণ-মহাকাব্যের প্রতি আনুকূল্য লক্ষ করা যায়।
বাংলায় ইসলামি শাসন কায়েম হলে অনেক পাঠান সুলতান হিন্দু কবি-পণ্ডিতদের থেকে রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবতের গল্প শুনতে আগ্রহী হন, অনুবাদ রচনায় তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেন। যেমন- রুকনুদ্দিন বারবক শাহ মালাধর বসুকে ভাগবতের অনুবাদ ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ রচনার জন্য ‘গুণরাজখান’ উপাধি দেন। চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খাঁ ও তাঁর পুত্র ছুটি খাঁ তাঁদের হিন্দু সভাকবিদের দিয়ে মহাভারত অনুবাদ করিয়ে দেন। সাহিত্য-অনুবাদের এই ধারার মাধ্যমে সমাজে অসাম্প্রদায়িক ঔদার্যের ছবিই ফুটে ওঠে এবং তা সমাজ-সংস্কৃতির পুনর্গঠনে বিশেষভাবে সহায়ক হয়।
বাংলা ভাষায় রামায়ণের প্রথম অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা। আনুমানিক ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে নদীয়া জেলার অন্তর্গত ফুলিয়ায় তাঁর জন্ম হয়। ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ হিসেবে প্রচলিত, জনপ্রিয় গ্রন্থটি শ্রীরামপুরের খ্রিস্টীয় যাজকেরা প্রথম মুদ্রিত করেন (১৮০২-০৩)। পরে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার দ্বিতীয় সংস্করণে দুই খণ্ডে প্রকাশ করেন(১৮৩০-৩৪)। তিনি সম্ভবত রাজা দনুজমর্দন কংস গণেশের (গৌড়) সভা অথবা তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণের সভা অলংকৃত করতেন। কৃত্তিবাস মূল রামায়ণের অনুবাদকালে তাকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছেন এবং কাব্যকায়াকে আধুনিক কাব্য করে গড়ে তুলেছেন। তাঁর অনূদিত গ্রন্থের নাম ‘শ্রীরাম পাঁচালি’। বহু শতাব্দীব্যাপী আপামর জনসাধারণের মধ্যে তাঁর কাব্যের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ রামায়ণের মূল চরিত্রগুলির মধ্যে বাঙালি স্বভাবের প্রক্ষেপণ, কাব্যে প্রতিফলিত বাংলার পরিবেশ ও প্রাত্যহিক জীবনচিত্র, ভক্তি ও করুণরসের সর্বজনগ্রাহ্যতা এবং সাধারণ মানুষের মননে সহায়ক পাঁচালির ঢঙ। গবেষকদের অনুমান পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কবি তাঁর এই কাব্য রচনা করেছিলেন।
● পঞ্চদশ শতাব্দী :
কৃত্তিবাস ওঝা — শ্রীরাম পাঁচালি
মাধব কন্দলি — শ্রীরাম পাঁচালি
● ষোড়শ শতাব্দী :
শঙ্কর দেব — শ্রীরাম পাঁচালি (উত্তর কাণ্ড)
● সপ্তদশ শতাব্দী :
নিত্যানন্দ আচার্য — অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণ
রামশঙ্কর দত্ত — রাম কথা
‘দ্বিজ’ অথবা পতিত ভবানীনাথ — লক্ষ্মণ দিগ্বিজয়
দ্বিজ শ্রীলক্ষ্মণ — অধ্যাত্ম রামায়ণ
চন্দ্রাবতী — রামায়ণ
● অষ্টাদশ শতাব্দী :
ফকির রাম ‘কবিভূষণ’ — অঙ্গদ রায়বার
রামচন্দ্র — বিভীষণের রায়বার
রামনারায়ণ — বিভীষণের রায়বার
কাশীরাম — কালনেমির রায়বার
দ্বিজ তুলসী — অঙ্গদ রায়বার
খোশাল শর্মা — অঙ্গদ রায়বার
জগন্নাথ দাস — লঙ্কাকাণ্ড
দ্বিজ দয়ারাম — তরনীসেনের যুদ্ধ
কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী — অধ্যাত্ম রামায়ণ
দ্বিজ শিবরাম — লক্ষ্মণ শক্তিশেল
উৎসবানন্দ — সীতার বনবাস
জগৎরাম রায় — অদ্ভুত রামায়ণ
কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণের অনুবাদে যথেষ্ট মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি অনেকাংশেই বাল্মীকির প্রদর্শিত পথে না গিয়ে নিজ কল্পনা অনুসারে চরিত্র চিত্রণ ও ঘটনা বর্ণনা করেছেন। বীরত্বের গরিমা প্রচার নয়, রাম চরিত্রের মাধুর্য বর্ণনাই তাঁর অন্বিষ্ট। তাঁর কাব্যের মূল সুর ভক্তি। বাঙালি হৃদয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনাদর্শ, কল্পনা, সমাজ-ভাবনা, জীবন-অভিজ্ঞতা তাঁর কাব্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বাঙালির নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মজীবনে তাঁর কাব্যের বিপুল প্রভাব লক্ষ করা যায়। এই নৈতিকতা পরে অনেক বাংলা উপন্যাস গুলোর মধ্যও প্রতিফলিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে বহু কবির প্রক্ষেপ, লিপিকরদের হাতে পরিবর্তন তাঁর কাব্যের রূপটিকে যেমন বদলে দিয়েছে, বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবও রামায়ণের অনুবাদে ব্যাপক বদল ঘটিয়েছে।
চৈতন্যোত্তর যুগের রামায়ণের মধ্যে ‘অদ্ভুতাচার্যের রামায়ণ’ উল্লেখযোগ্য। পাবনা জেলার অমৃতকুণ্ডা গ্রামে ১৭শ শতকের শেষভাগে আবির্ভূত সাঁতোলের রাজা রামকৃষ্ণের সভাকবি নিত্যানন্দ আচার্যের এই রচনা উত্তরবঙ্গে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কবি ‘অদ্ভুত রামায়ণ’, ‘অধ্যাত্ম রামায়ণ’, ‘রঘুবংশম্’ থেকে তাঁর কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। ইনি ছাড়া আর যাঁরা বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন —- কৈলাস বসু, দ্বিজ ভবানীদাস, দ্বিজ শ্রীলক্ষ্মণ চক্রবর্তী, কবিচন্দ্র প্রমুখ।
রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি লোকশিক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। কৃত্তিবাস ওঝা স্বয়ং লিখেছেন — ‘লোক বুঝাইতে কৈল কৃত্তিবাস পণ্ডিত ‘। রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় অগণিত কবি মহাভারত রচনাতেও আত্মনিয়োগ করেন। কেউ কোনো বিশেষ পর্ব বা উপাখ্যান নিয়ে, কেউ বা সমগ্র মহাভারত কাব্যের অনুবাদ করেন। খ্রিস্টীয় আনুমানিক ষোড়শ শতকে বাংলায় মহাভারত রচনা শুরু হয়। বাংলায় সংস্কৃত মহাভারতের প্রথম কবি সম্ভবত পরমেশ্বর দাস, যিনি তাঁর কাব্যে ‘কবীন্দ্র’ উপাধি ব্যবহার করেছেন। তাঁর কাব্যের নাম ‘পাণ্ডববিজয় পাঞ্চালিকা’। বাংলার শাসনকর্তা হুসেন শাহের রাজত্বকালে তাঁরই এক সেনাপতি, চট্টগ্রামের শাসনকর্তা লস্কর পরাগল খানের আদেশে রচিত আঠারো পর্বে সমাপ্ত এই কাব্যটিকে ‘পরাগলী মহাভারত’ও বলা হয়।
পরাগল খানের পর তাঁর পুত্র নসরৎ খান, যিনি ছুটি খান বা ছোটে খাঁ নামেই পরিচিত ছিলেন, চট্টগ্রামের শাসক হন। মহাভারত-কাহিনির প্রতি অনুরক্ত হয়ে তিনি তাঁর সভাকবি শ্রীকর নন্দীকে দিয়ে মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের বিস্তৃত অনুবাদ করান, যার কাহিনি কবি প্রকৃতপক্ষে জৈমিনী সংহিতা থেকে গ্রহণ করেছেন।
● ষোড়শ শতাব্দী :
‘কবীন্দ্র’ পরমেশ্বর দাস — পাণ্ডব বিজয়
শ্রীকর নন্দী — অশ্বমেধ কথা
রামচন্দ্র খান — অশ্বমেধ পর্ব
দ্বিজ রঘুনাথ — অশ্বমেধ পাঁচালি
অনিরুদ্ধ — ভারত পয়ার
রুদ্রদেব — আদিপর্ব
দ্বিজ বলরাম — বন পর্ব
বৈদ্য পঞ্চানন — কর্ণ পর্ব
রামনন্দন — শল্য পর্ব
দ্বিজ বৈদ্যনাথ — শান্তি পর্ব
● সপ্তদশ শতাব্দী :
কাশীরাম দাস — মহাভারত
নিত্যানন্দ ঘোষ — মহাভারত
কৃষ্ণানন্দ বসু — শান্তিপর্ব ও স্বর্গারোহণ পর্ব
রামনারায়ণ দত্ত — দ্রোণ পর্ব
দ্বিজ হরিদাস — অশ্বমেধ পর্ব
ঘনশ্যাম দাস — অশ্বমেধ পর্ব
‘সঞ্জয়’ — মহাভারত
● অষ্টাদশ শতাব্দী :
দুর্লভ সিংহ — ভারত পাঁচালি
গোপীনাথ পাঠক — সভা পর্ব
সুবুদ্ধি রায় — অশ্বমেধ পর্ব
পুরুষোত্তম দাস — পাণ্ডব পাঁচালি
দ্বিজ রামলোচন — শ্রী পর্ব
দ্বৈপায়ন দাস — ভারত পাঁচালি
ষোড়শ শতকে রামচন্দ্র খান নামে এক ভক্ত বৈষ্ণব কবিও জৈমিনী সংহিতা অবলম্বনে অশ্বমেধ পর্বের অনুবাদ করেন। এছাড়া এই শতকে পীতাম্বর দাস মহাভারতের নল-দময়ন্তী কাহিনি নিয়ে একটি পাঁচালি কাব্য রচনা করেন। কবি দ্বিজ রঘুনাথ ‘অশ্বমেধ পাঁচালী’ রচনা করেন। কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণের ভাই শুক্লধ্বজের প্রেরণায় কবি অনিরুদ্ধ ‘ভারত-পাঁচালী’ রচনা করেন।
সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত মহাভারতের মধ্যে নন্দরাম দাসের উদ্যোগ ও দ্রোণপর্ব, বিশারদ ভণিতাযুক্ত বন ও বিরাটপর্ব, নিত্যানন্দ ঘোষের ‘ভারত-পাঁচালী’, অনন্ত মিশ্রের ‘অশ্বমেধ পর্ব’, দ্বিজ হরিদাসের ‘অশ্বমেধ পর্ব’, দ্বিজ হরিদাসের ‘অশ্বমেধ পর্ব’, দ্বিজ হরিদাসের ‘অশ্বমেধ পর্ব’, রামেশ্বর নন্দীর ‘মহাভারতের আদিপর্ব’; শ্রীনাথ ব্রাহ্মণ রচিত ‘ভারত-পাঁচালী’ উল্লেখযোগ্য।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত উল্লেখযোগ্য মহাভারত কাহিনির মধ্যে রয়েছে রাজীব সেনের ‘উদ্যোগ পর্ব’, দ্বিজ ঘনশ্যামের ‘অশ্বমেধ পর্ব’, দ্বিজ কৃষ্ণরাম, প্রেমানন্দের ভণিতায় ‘অশ্বমেধ পর্ব’, রাজেন্দ্রদাসের ‘মহাভারত, আদিপর্ব’ ইত্যাদি। কবিচন্দ্র, যষ্ঠীবর সেন এবং গঙ্গাদাস সেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে সম্পূর্ণ মহাভারত রচনা করেন।
বাংলা ভাষায় মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বর্তমান ছিলেন। পিতা কমলাকান্ত দাস। বর্ধমানের কাটোয়া অঞ্চলের সিঙ্গিগ্রাম অথবা দাইহাটের নিকটবর্তী সিঙ্গিগ্রাম অঞ্চলে সম্ভবত তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল। তিনি মহাভারতের কটি পর্ব অনুবাদ করেছিলেন, তা ঠিক জানা না গেলেও, তাঁর মহাভারতের প্রথম চার পর্ব (১৮০১-০৩) শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এই প্রেস থেকেই সম্পূর্ণ অংশ জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রিত হয়। শ্রীরামপুর মিশন কর্তৃক কাশীদাসী মহাভারতের মুদ্রণ, প্রকাশ ও প্রচার এর জনপ্রিয়তার সহায়ক হয়েছিল। মধুর শব্দ, অলঙ্কার, উপমা, ছন্দ ব্যবহারে নিপুণ কবি কাশীরাম দাস পুরাণ কাহিনি, পূর্ববর্তী কবিদের প্রভাব এবং বাঙালি চরিত্র ও সংস্কৃতির নিবিড় জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তাঁর কাব্য রচনা করেছেন। মেদিনীপুরের আবাসগড়ের রাজার আশ্রয়ে থেকে লিক্ষকতা জীবন অতিবাহিত করার সুবাদে রাজবাড়িতে আসা পুরাণজ্ঞ পণ্ডিত ও কথকদের মুখে মহাভারত কথা শুনে তিনি তা অনুবাদে উৎসুক হয়ে পড়েন। সমগ্র কাব্যটি তাঁর নামে চললেও আদি, সভা, বন পর্বের পর বিরাট পর্বে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই তিনি লোকান্তরিত হন। ভারত পাঁচালি কাব্যের কবিরূপেও তাঁর খ্যাতি ছিল। তাঁর নামে রচিত ‘সত্যনারায়ণের পুঁথি’, ‘স্বপ্নপর্ব’, ‘জলপর্ব’ ও ‘নীলোপাখ্যান’ প্রভৃতি গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায়। আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে অথবা সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তাঁর কাব্যটি রচিত হয়েছিল।